মণিরাজ ঘোষ, পশ্চিম মেদিনীপুর, ১২ সেপ্টেম্বর : পশ্চিম মেদিনীপুরের একমাত্র লেভেল ফোর করোনা হাসপাতাল শালবনী সুপার স্পেশালিটি’র (Level Four Corona Hospital) চিকিৎসা পরিষেবা ও পরিকাঠামোগত নানান অভাব-অভিযোগ বা ত্রুটি-বিচ্যুতি নিয়ে গত কয়েক সপ্তাহ ধরেই জেলা একপ্রকার উত্তাল হয়ে উঠেছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে, গত দেড় মাসে প্রায় চল্লিশ-পঞ্চাশ জনের মৃত্যু! বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কো-মর্বিডিটি থাকলেও, হঠাৎ করে শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়ে মৃত্যু হয়েছে বেশ কিছু সুস্থ সবল করোনা সংক্রমিত ব্যক্তির, এমনটাই জানা গেছে বিভিন্ন মহল থেকে। আর এই তালিকায়, একেবারে তরতাজা যুবকেরাও আছেন! চিকিৎসা পরিষেবা এবং পরিকাঠামোগত বেশকিছু সমস্যার কারণে, একদিকে যেমন শাসকদলের নেতা-নেত্রীরা ক্ষুব্ধ, ঠিক তেমনই সোশ্যাল মিডিয়ায় ক্ষোভ উগরে দিচ্ছেন নেতা-কর্মী-সমর্থক থেকে সাধারণ মানুষ। আর বিরোধীরা’তো গত একমাস ধরে তীব্র বিষোদগার থেকে শুরু করে ডেপুটেশন সবকিছুই করছেন। খবর পৌঁছেছে রাজ্য স্বাস্থ্য দপ্তরেও! ফলস্বরূপ হয়েছে, সুপার বদলি। প্রাক্তন সুপার (শালবনীর বিএমওএইচ) ডাঃ অভিষেক মিদ্যা’কে সরিয়ে সুপারের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে প্রাক্তন ডেপুটি সুপার ডাঃ নবকুমার দাস’কে। সমালোচকেরা এটিকে ‘নজর ঘোরানো’ বলতে চাইলেও, তা মানতে রাজি নয় জেলা প্রশাসন এবং জেলা স্বাস্থ্য দপ্তর। জেলা প্রশাসনের বক্তব্য, বিএমওএইচ বা ব্লক স্বাস্থ্য আধিকারিক হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করে যাবেন, সঙ্গে করোনা হাসপাতালে’র সঙ্গেও যুক্ত থাকবেন। তাঁর চাপ একটু কমানো হয়েছে। জেলা স্বাস্থ্য দফতরের পক্ষ থেকে মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক ডাঃ নিমাই চন্দ্র মন্ডল জানিয়েছেন, “ডেপুটি সুপার নবকুমার দাস’কে সুপারের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। দু’জন অ্যাসিস্ট্যান্ট সুপার আছে, তাঁকে সহযোগিতা করবেন। সঙ্গে, চিকিৎসা পরিষেবা ও পরিকাঠামোগত আরো বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আগে প্রায় ১৪০ টি বেডে অক্সিজেন থাকলেও, বর্তমানে ২০০ টি বেডেই অক্সিজেনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সিসিইউ এবং ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা আগে থেকেই ছিল, সেই বিষয়গুলি সঠিকভাবে পরিচালনা করার জন্য উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।”
লেভেল ফোর শালবনী’র চিকিৎসা পরিষেবা ও পরিকাঠামোগত অভাব-অভিযোগের কথা পরোক্ষে স্বীকার করে জেলার জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ বিষয়ক কর্মাধ্যক্ষ শ্যামপদ পাত্র জানিয়েছেন, “পরপর কয়েকটি মৃত্যুর পর বিভিন্ন অভিযোগ এসেছিল। রাজ্য প্রশাসনের কাছেও পৌঁছেছিল বলে শুনেছি। তবে, তৎক্ষণাৎ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক সহ অন্যান্য আধিকারিকেরা পরপর বেশ কয়েকদিন, শালবনীতে গিয়ে সমস্ত ব্যবস্থা খতিয়ে দেখে উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। এই অতিমারীতে স্বাস্থ্য যোদ্ধারাও আক্রান্ত হচ্ছেন একের পর এক। তাই, মানুষকে একটু ধৈর্য ও সহানুভূতিশীল হওয়ার আহ্বান জানাবো। এই পরিস্থিতির মধ্যেও চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা চেষ্টা করে যাচ্ছেন। দু’একটি ক্ষেত্রে সমস্যা হয়েছে ঠিকই, সেগুলিও দূর করে সঠিক পরিষেবা দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। সকলকে আরো সচেতন ও সহমর্মী হতে বলবো।” এদিকে, করোনা আক্রান্ত প্রসূতিদের নিয়ে একটি বড়সড় সমস্যা হচ্ছিল জেলায়। নর্মাল ডেলিভারি বা স্বাভাবিক প্রসবের ক্ষেত্রে, শালবনী করোনা হাসপাতালে সাফল্য এলেও (গত ২৩ শে আগস্ট সুস্থ সন্তান জন্ম দিয়ে এবং করোনা মুক্ত হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন বেলদা’র ২৩ বছর বয়সী গৃহবধূ সুস্মিতা সাউ), সিজারিয়ান ডেলিভারির ক্ষেত্রে মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ ছাড়া কোনো উপায় ছিলনা! এদিকে, মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজে করোনা আক্রান্তদের জন্য বিশেষ ওয়ার্ডের ব্যবস্থা করার কাজ চলছে। গত সপ্তাহেও সেই ব্যবস্থা না থাকায়, দু-একটি ক্ষেত্রে করোনা পজিটিভ প্রসূতিদের চরম ভোগান্তি হয়েছে। দ্য বেঙ্গল পোস্ট সহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে তা প্রকাশিত হওয়ার পর, নড়েচড়ে বসেছে জেলা প্রশাসন ও কলেজ কর্তৃপক্ষও। গত সপ্তাহে মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ ডাঃ পঞ্চানন কুন্ডু জানিয়েছিলেন, ওই ওয়ার্ড তৈরি করা হচ্ছে, খুব শীঘ্রই তা হয়ে যাবে। কিন্তু, এর মাঝেই করোনা আক্রান্ত এক প্রসূতির ভর্তি নিয়ে টালবাহানায় সরগরম হয়ে ওঠে পরিস্থিতি। গত ১০ সেপ্টেম্বর স্বয়ং জেলাশাসক ডঃ রশ্মি কমল মেডিক্যাল কলেজের পরিকাঠামো এবং করোনা চিকিৎসা সংক্রান্ত বিশেষ ওই ওয়ার্ডগুলি তৈরির বিষয়টি খতিয়ে দেখেন। সংক্রমিত হওয়ার কারণে, ওই দিন অবশ্য কলেজের অধ্যক্ষ ডাঃ কুন্ডু উপস্থিত থাকতে পারেননি। তবে, সুপার ও ডেপুটি সুপারেরা ছিলেন। করোনা আক্রান্ত প্রসূতিদের সিজারিয়ান অপারেশনের জন্য বিধান ব্লকের পুরানো লেবার রুমে ব্যবস্থা করা হচ্ছে বলে আগেই জানিয়েছিলেন কলেজের অধ্যক্ষ। জেলাশাসকের পরিদর্শনে পর সামনের সপ্তাহ থেকেই তা শুরু হয়ে যাবে বলে খবর। এছাড়াও, সারি (SARI) এবং এইচডিইউ (HDU) ইউনিট গুলিও শুরু হয়ে যাবে বলে খবর। জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক ডাঃ নিমাই চন্দ্র মন্ডল এই বিষয়টি’র সাথে আরো সংযোজন করেছেন, “ঘাটালের সেফ হোমেও করোনা সংক্রমিত প্রসূতিদের নর্মাল ডেলিভারি’র ব্যবস্থা করা হচ্ছে। আর শালবনীতে তো তা আছেই।” জেলার উপ মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক ডাঃ সৌম্যশঙ্কর সারেঙ্গীও জানিয়েছেন, “প্রতিটি করোনা হাসপাতাল ও সেফ হোমের পরিষেবা আরো উন্নত করা হচ্ছে, জেলা প্রশাসন ও স্বাস্থ্য দপ্তরের উদ্যোগে। তবে, রহস্যময় এই ভাইরাসের প্রকোপে কিছু দুর্ঘটনা ঘটলে পুরো সিস্টেমটাকেই আক্রমণ করা উচিত। তাতে, চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের মনোবল আরো ভেঙে যাবে। প্রতিটি বিষয় আরো খতিয়ে দেখে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।” তবে, সমস্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলেও, সবথেকে বড় সমস্যা যে পূর্ণ সময়ের জন্য উপযুক্ত সংখ্যক চিকিৎসকের, তা পরোক্ষে মেনে নিচ্ছে সংশ্লিষ্ট সব মহলই! বিশ্বস্ত সূত্রের খবর অনুযায়ী, এই বিষয়টি নিয়ে জেলা ও রাজ্য প্রশাসনও ওয়াকিবহাল এবং সমাধানের ক্ষেত্রে উদ্যোগী। তবে, বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে বর্তমান পরিস্থিতি, যখন একের পর এক চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী সংক্রমিত হচ্ছেন এবং দু’একটি ক্ষেত্রে চরম দুর্ঘটনাও ঘটছে। তা সত্বেও প্রচেষ্টা জারি আছে স্বাস্থ্যযোদ্ধাদের পক্ষ থেকে। জেলা স্বাস্থ্য ভবন সূত্রে জানা গেছে, সিসিইউ ট্রেনিং সহ উন্নত চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়ার জন্য, শালবনীর কয়েকজন চিকিৎসককে কলকাতায় পাঠানো হয়েছে ট্রেনিং এর জন্য এবং বিভিন্ন পর্যায়ে ১০ জনের ব্যাচ বা গ্রুপ করে নার্সদের পাঠানো হচ্ছে মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজে, সিসিইউ ট্রেনিংয়ের জন্য। যাতে, জরুরী প্রয়োজনে আশঙ্কাজনক করোনা রোগীদের চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়া সম্ভব হয়। আবার, জেল ও শহরের একটি সচেতন মহল থেকে দাবি করা হচ্ছে, মেদিনীপুর শহরের উন্নত বেসরকারি হাসপাতালগুলিতেও করোনা চিকিৎসার অনুমতি দেওয়া হোক, কলকাতার মতো। সেক্ষেত্রে, পরিষেবা কিছুটা বৃদ্ধি হবে। তবে, এও দাবি করা হয়েছে, চিকিৎসার খরচ সংক্রান্ত বিষয়গুলি যেন প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণাধীনে থাকে!

অপরদিকে, শালবনী করোনা হাসপাতালে ফের এক সরকারী দপ্তরের কর্মীর মৃত্যু হল! দাঁতন ২ নং ব্লকের সাউরি গ্রামের বাসিন্দা, বছর পঞ্চান্নর গ্রাম পঞ্চায়েত কর্মী নিতাই চন্দ্র দাসের মৃত্যু হয়েছে শুক্রবার রাতে। জানা যায়, বাখরাবাদ পঞ্চায়েত অফিসের নির্মাণ সহায়ক নিতাই বাবু, গত সোমবার (৭ সেপ্টেম্বর) করোনায় আক্রান্ত হন। বুধবার তাঁকে শালবনী করোনা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। হাসপাতাল সূত্রে খবর, শুক্রবার রাতে মারা যান ওই নির্মান সহায়ক কর্মী।
*আরো পড়ুন: করোনা মৃত্যুতে সেঞ্চুরি করল পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা…..